SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - ইংরেজ শাসন আমলে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন | NCTB BOOK

পলাশি যুদ্ধের একশ' বছর পর ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে প্রধানত সিপাহিদের নেতৃত্বে যে সশস্ত্ৰ বিদ্ৰোহ সংঘটিত হয়, তাকেই ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা হয় । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিকভাবে হেয় করা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা, সর্বোপরি ভারতীয় সৈনিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ- এসবই এই সংগ্রামের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। নিম্নে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের কারণসমূহ উল্লেখ করা হলো ।

রাজনৈতিক : পলাশি যুদ্ধের পর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজ্য বিস্তার, একের পর এক দেশীয় রাজ্যগুলো দখল, দেশীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে ভীতি, অসন্তোষ ও তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয় । লর্ড ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে সাতারা, ঝাঁসি, নাগপুর, সম্বলপুর, ভগৎ, উদয়পুর, করাউলি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । স্বত্ববিলোপ নীতি অনুযায়ী দত্তক পুত্র সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারত না । তাছাড়া অপশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয় । এসব ঘটনায় দেশীয় রাজন্যবর্গ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন ।

অর্থনৈতিক : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় চরম অর্থনৈতিক শোষণ বঞ্চনা । কোম্পানি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের আগেই এদেশের শিল্প ধ্বংস করেছিল । ক্ষমতা দখলের পর ভূমি রাজস্ব নীতির নামে ধ্বংস করা হয় দরিদ্র কৃষকের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। আইন প্রয়োগের ফলে অনেক বনেদি জমিদার সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন । দরিদ্র কৃষকের ওপর অতিরিক্ত কর ধার্য করা হয় । জমিদার ও রাজস্ব আদায়কারীদের তীব্র শোষণের শিকার এসব কৃষক মহাজনদের কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে । একদিকে বাজার দখলের নামে স্থানীয় শিল্প ধ্বংস, অপর দিকে অতিরিক্ত অর্থ লাভের আশায় জমি বন্দোবস্তের নামে কৃষি ধ্বংস হয়। ফলে বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় । এ অবস্থার শিকার সাধারণ মানুষ কোম্পানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ।

সামাজিক ও ধর্মীয় : উপমহাদেশের জনগণের ক্ষোভের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল সামাজিক ও ধর্মীয়। আঠারো শতকের শেষ ভাগে এবং উনিশ শতকের প্রথমার্ধে পাশ্চাত্যের প্রভাব, কোম্পানির সমাজ সংস্কার জনকল্যাণমূলক হলেও গোটা রক্ষণশীল হিন্দু-মুসলমান এসব মেনে নিতে পারেনি। ইংরেজি শিক্ষা, সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ, হিন্দু বিধবাদের পুনরায় বিবাহ, খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের ধর্ম প্রচার ইত্যাদির ফলে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের গোঁড়াপন্থীরা শঙ্কিত হয়ে ওঠে। ধর্ম ও সামাজিক রীতিনীতি বিভিন্নভাবে সংস্কারের কারণে ক্ষুব্ধ হয় উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ।

সামরিক : সামরিক বাহিনীতে ইংরেজ ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যকার বৈষম্য বিদ্রোহের অন্যতম কারণ । ইংরেজ সৈন্য ও ভারতীয় সিপাহিদের মধ্যে পদবি এবং বেতন-ভাতার মধ্যে বিরাট বৈষম্য ছিল। ভারতীয়দের সুযোগ-সুবিধাও কম ছিল। তাছাড়া পদোন্নতির সুযোগ থেকেও তারা বঞ্চিত ছিল। তার ওপর ব্রিটিশ অফিসারদের পক্ষপাতিত্ব, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ সিপাহিদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয় । তাছাড়া হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সিপাহিদের ব্যবহারের জন্য 'এনফিল্ড' রাইফেলের প্রচলন করা হয়। এই রাইফেলের টোটা দাঁত দিয়ে কেটে বন্দুকে প্রবেশ করাতে হতো। সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপকভাবে এ গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, এই টোটায় গরু ও শূকরের চর্বি মিশ্রিত আছে। ফলে উভয়ই ধর্মনাশের কথা ভেবে বিদ্রোহী হয়ে উঠল ।

স্বাধীনতা সংগ্রাম : বিদ্রোহের আগুন প্রথমে জ্বলে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরে। ১৮৫৭ সালের ২৯শে মার্চ বন্দুকের গুলি ছুড়ে বিদ্রোহের সূচনা করেন মঙ্গল পাণ্ডে নামে এক সিপাহি। দ্রুত এই বিদ্রোহ মিরাট, কানপুর, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বিহার, বাংলাসহ ভারতের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, সিলেট, কুমিল্লা, পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী এই বিদ্রোহে শামিল হয় । বিদ্রোহীরা দিল্লি দখল করে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতবর্ষের বাদশা বলে ঘোষণা করে। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নানা সাহেব, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, অযোদ্ধার বেগম হজরত মহল, মৌলভি আহমদ উল্লাহসহ ক্ষুব্ধ বঞ্চিত দেশীয় রাজন্যবর্গ । বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় সিপাহি ও যুদ্ধরত বিদ্রোহী নেতারা প্রাণপণ লড়াই করে পরাজিত হন। এই সংগ্রামে জড়িত অধিকাংশই যুদ্ধে শহিদ হন, বাকিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।

মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে (মিয়ানমার) নির্বাসিত করা হয় । রানি লক্ষ্মীবাঈ যুদ্ধে নিহত হন। নানা সাহেব পরাজিত হয়ে অন্তর্ধান করেন। সাধারণ সৈনিক বিদ্রোহীদের ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে ঝুলিয়ে রাখা হয় অনেক সৈনিকের লাশ। এ ধরনের বীভৎস ঘটনা ঘটিয়ে শাসকগোষ্ঠী জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করে। ফলে নির্যাতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম । ১৮৫৮ সালের জুলাইয়ের মধ্যে সব আন্দোলন শেষ হয়ে যায় । তবে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।

প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্ব : এই বিদ্রোহের তাৎক্ষণিক গুরুত্বও ছিল। এর ফলে কোম্পানি শাসনের অবসান হয় । এরপর থেকে ব্রিটিশ সরকার ভারতের শাসনভার নিজ হাতে গ্রহণ করে । ১৮৫৮ সালের ১লা নভেম্বর মহারানি ভিক্টোরিয়ার এক ঘোষণাপত্রে স্বত্ববিলোপ নীতি এবং এর সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য নিয়ম বাতিল করা হয় । তাছাড়া এই ঘোষণাপত্রে যোগ্যতা অনুযায়ী ভারতীয়দের চাকরি প্রদান এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তাসহ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করা হয় । মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করা হয় । এই বিদ্রোহের সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব হচ্ছে এই বিদ্রোহের ক্ষোভ থেমে যায়নি। এই সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ সচেতন হয়ে ওঠে এবং আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটায় ।

Content added By